এটি আমাদের জাতীয় লজ্জা যে, আমরা ভুলে গেছি ১৯৮৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারীর ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের রক্তাত্ব দিনটির কথা। আজকের কোন পত্রিকা বা টিভি'র পাতায় একবারও স্মরণ করা হয়নি সেই সংগ্রামী দিনটির কথা। শুধু ব্লগের জগতে ক'জন আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন এই জাতীয় লজ্জার দিনটির কথা।
সচলায়তনে গৌতম লিখেছেন:ফেব্রুয়ারি ১৪:ব্যবসায়িক ভালোবাসা,নাকি চেতনার রক্তাক্ত জমিন? তিঁনি লিখছেন:
...মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল না করলে যে নিজেদের অস্তিত্ব লুটিয়ে পড়ে! অস্তিত্ব রক্ষায় প্রকম্পিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা শহর, বাংলাদেশ। স্বৈরাচার এরশাদের গুলিবাহিনী ট্রাক তুলে দেয় মিছিলের ওপর। গুলি-টিয়ার শেল। গ্রেফতার। হাজার হাজার। ছাত্র। ছাত্রী। জনতা। কৃষক। শ্রমিক। চাকুরে। শিক্ষক। মানুষ। প্রতিবাদে পরদিন হরতাল। আবারো গুলিবাহিনীর সক্রিয়তা। শহীদ হন জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থী আইয়ুব-কাঞ্চন। অনেকে বলেন, এই দুই দিনে শহীদ হন ৫০ জনেরও বেশি। শোনা যায়, চট্টগ্রামে শহীদ হয়েছিলেন ৪-৫ জন। তাঁদের লাশ নেই। এরশাদের গুলিবাহিনী গুম করে দিয়েছিল। এই উত্তাল কদিনে ক্যাম্পাসে রাজত্ব করতে চেয়েছিল বুটের শব্দ। কার্জন হল-কলাভবন-সায়েন্স অ্যানেক্স-মহসিন হল-জগন্নাথ হল-জহুরুল হক হল। প্রথমবারের মতো আক্রান্ত হয় বুয়েট ক্যাম্পাস। কোথায় ছিল না তারা? ফুলবাড়ির রাস্তা সেদিন খুব তাড়াতাড়ি শুষে নিয়েছিল গ্যালন গ্যালন রক্ত, যাতে বুটের ফণায় লোহিত কণাগুলো অপমানিত না হয়।সচলায়তনে নজরুল ইসলাম লিখছেন, "১৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩" শিরোনামে। সাথে রয়েছে সেদিনকার ছাত্র আন্দোলনের সচিত্র বক্তব্য। তিঁনি লিখছেন,
১৯৮৩ সালের এই ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি খুব দুঃসহ। বিশেষত তখন যারা তরুণ ছিলেন, তাঁদের স্মৃতি যদি কোনোমতে আমরা মন্থন করতে পারতাম! আপনি হয়তো নানা কথাবার্তায় জেনে গেছেন- এই দিনটিতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবগুলো ছাত্র সংগঠন প্রথম একসঙ্গে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। অনেকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী প্রথম সংঘবদ্ধ উত্থানের দিন ছিল এই দিনটি।
...কিছুটা হলেও এই দিবসটি একসময় পালন হতো। যায়যায়দিন নামক একটি সাপ্তাহিকের সম্পাদক জেনেশুনেই এই দিবসটিকের তাৎপর্য ক্ষুণ্ন করার জোরালো উদ্যোগ নেয় তার পত্রিকার মাধ্যমে। ভালোবাসা দিবস পালনের নামে আত্মত্যাগের ঘটনাকে সরিয়ে দিয়ে আদেখলাপনার বেসাতি গড়ে তুলে।
আচ্ছা, এটা শফিক রেহমানদের সফলতা? নাকি আমাদেরও ব্যর্থতা?
...মজিদ খান প্রস্তাবিত স্বৈরশাসক এরশাদের বিতর্কিত শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সামরিক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, লাঠি গুলি টিয়ার গ্যাসকে পরোয়া না করে, গ্রেফতার নির্যাতন হুমকি হত্যার তোয়াক্কা না করে সেই যে মানুষ রাস্তায় নেমেছিলো '৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে, সেখান থেকেই মূলত এরশাদ বিরোধী গণআন্দোলনের সূত্রপাত। '৮৩র ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখেই এদেশে সামরিক শাসনের ভীত কাঁপিয়ে দেয় সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্ররা। ধীরে ধীরে যা সার্বিক গণআন্দোলনে রূপ লাভ করে। এবং সবশেষে ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটে।মুক্তাঙ্গনে একই অনুভূতির প্রতিধ্বনিত হয় অবিশ্রুত'র লেখায়। তিঁনি লিখছেন,"১৪ ফেব্রুয়ারি : তারুণ্যের সেই এক উত্থান দিন"শিরোনামে:
বস্তুতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের পর মধ্য ফেব্রুয়ারির এই আন্দোলনই বাংলাদেশের প্রথম গণ আন্দোলন। এবং যা বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত থামেনি।
১৪ ফেব্রুয়ারি তাই যেন তেন কোনো দিবস না...
এই অবিস্মরণীয় বিপ্লব এবং বিজয়কে বহুবছর পরে ভালোবাসা দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে এগিয়ে আসেন শফিক রেহমান নামক একজন সাংবাদিক। লাল গোলাপ হাতে তিনি বিপ্লব ভুলে ভালোবাসার জয়গানে দেশবাসীকে মাতোয়ারা হতে আহ্বান জানান। দেশে ঢুকে যায় আর্চিস হলমার্ক।
প্রেম ভালোবাসাবাসির এই জোয়ার আমরা এখনো দেখি। সম্প্রতি আমরা দেখছি একটি সিনেমা বানিয়ে একটি গোষ্ঠী আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে "প্রেম" দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চাইছেন। ডিকন্সট্রাকশন! তার হাতে গোলাপ ফুল নেই, তবে ফিল্ম জুড়ে গোলাপী রঙ ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। গোলাপ এবং প্রেম ভালোবাসার কাছে সর্বদাই কি হেরে যাবে আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলো?
...আমি খুবই নগণ্য মানুষ, রক্তমাংসের মানুষ, তাই জাফর জয়নালদের এখনও ভুলতে পারিনি, সেলিম দেলোয়ারদের ভুলিনি, তিতাস-তাজুলদের ভুলতে পারিনি, ময়েজউদ্দিনকে ভুলতে পারিনি, বসুনিয়া-শাহজাহান সিরাজদের ভুলতে পারিনি। নূর হোসেনকেও ভুলতে পারিনি। সেই সঙ্গে এও মনে আছে, খুব স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের সামনে আমাদের গণতান্ত্রিক নেতারা কী কী দাবিদাওয়া ঘোষণা করেছিলেন, কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
আমি আমার অন্তরের অন্তস্তল থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ থেকে শুরু হয়ে নব্বইয়ের ডিসেম্বর অবধি শহীদ সবাইকে এই দিনটিতে স্মরণ করছি, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে আর্নেস্তো কার্দেনালের একটি কবিতার কথা। সেই কবিতার উচ্চারকের মতো আমিও শুধু হাহাকার করতে পারি এই বলে, কেন ওই সময় আমারও মৃত্যু হলো না সামরিক শাসকের গুলিতে। তা হলে প্রতিদিন এইভাবে গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকতে হতো না।
আমি জানি,কাল সকালে বাংলাদেশের প্রতিটি দৈনিক কাগজের পাতা জুড়ে থাকবে ভ্যালেন্টাইন,থাকবে না সেই সব শহীদদের কারও ছবি যারা আমাদের ভালোবাসার পথ অবারিত করে দেয়ার জন্যে জীবন দিয়েছিল সামরিক জান্তার বুলেটে।
তবু বিজয়ী বীর মুক্তি সেনা, তোমাদের এই ঋণ কোনওদিন শোধ হবে না…